Blog

06 May 2020

Author: Tamanna Binte Rahman

ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নগর পরিকল্পনা

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইনের ডক্টর অব ডিজাইন প্রোগ্রামের স্থাপত্য ও নগর-পরিকল্পনা গবেষক নূসরাত জাহানের “কোভিড-১৯ এবং ধর্ম ও নগরের সম্পর্ক” বিষয়ে প্রথম আলোতে লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আমার লেখাটির অবতারণা। লিংক লেখার শেষে দেয়া আছে।

অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও মূলত ৪ টি বিষয় অর্থনীতি, পরিবেশ, সামাজিক অবকাঠামো এবং ভৌতিক অবকাঠামোর উপর ভিত্তি করে একটি শহরের পরিকল্পনার প্রণয়ন করা হয় । যেকোন শহরের জনগণের সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক অবস্থা, ধর্মীয় মতবাদ, লৈংগিক অবস্থা, শিক্ষার অবস্থা, শিক্ষার ধরণ, বয়স, প্রতিবন্ধীদের অবস্থা, নাগরিকদের প্রত্যাশা ইত্যাদি সামাজিক শ্রেণি এবং বৈশিষ্ট্য ঐ শহরের সামাজিক অবকাঠামো নির্ধারণ করে। তাই লেখিকার “ধর্মকে এ রকম সীমাবদ্ধ করে রক্ষণশীল দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নগর-কল্পনা করা সম্ভব কি না, সেটা একটা বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল” প্রশ্নটাকে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। কারণ সামাজিক অবকাঠামো বিশ্লেষণ না করে কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে তাকে সু-পরিকল্পনা বলা যায়না। যেমন একটা শহর যদি নারী বান্ধব না হয় যেখানে প্রাকৃতিকভাবে জনসংখ্যার ৫০% নারী কিংবা শিশুবান্ধব না হয় অথবা প্রতিবন্ধী/বয়স্ক বান্ধব না হয় সেক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন আসবে। তাই লেখিকার “আমাদের দেশেও বিভিন্নভাবে ধর্মকে মূল বিবেচনার বাইরে রেখে ‘আধুনিক’ শহর বা নগর-পরিকল্পনাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে” এই মতবাদের ক্ষেত্রে আমি পুরোপুরি একমত নই। বরং আমি বলবো সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের জন্য যেধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের প্রয়োজন ছিল আমাদের শহরগুলোর জন্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়নে সেসকল সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়নে নগর কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ সময়েই ব্যর্থ হয়েছে অথবা বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। সেই সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই বরং আমরা বিচার/যাচাই করতে পারতাম যে সুপারিশগুলো যথার্থ ছিল কীনা এবং সেটা সামাগ্রিক বিবেচনায় হতে হয়; শুধুমাত্র একটা বৈশিষ্ট্য ‘ধর্মীয়’ বিবেচনায় নয়।

একটা শহরের জনসাধারণের সামাজিক রীতিনীতি পুরোটাই নির্ভর তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত অবস্থানের উপর। মুসলমান অধ্যুষিত শহর হলেই ঢাকা শহরের পরিকল্পনা আর জাকার্তা শহরের পরিকল্পনা তাই এক হবার উপায় নেই। ঠিক তেমনি বান্দরবান শহরের ৫০% মুসলিম হলেও বৌদ্ধসহ, খ্রিস্টান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থাকায় “সব ধর্মের মানুষের সমান সহাবস্থান একই নগরে হোক—এই চমৎকার ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল” যাকে নগর পরিকল্পনার ‘আধুনিক মডেল’ বিবেচনা করা হয় সেই বিষয়টি শুধু বান্দরবানে অনেকাংশে দারুনভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে মর্মে লক্ষ্য করা যায়। মজার বিষয় হল এই শহরে নগর পরিকল্পনা কোন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নগর পরিকল্পনাবিদ বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান করে দেয়নি। বরং এখানেই দেখা মেলে যথার্থ নেতৃত্র যাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করি ‘Charismatic leadership’ হিসেবে।

আমাদের দেশে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় ধর্মীয় স্থান/জোন উল্লেখ করে দিলেও পাশাপাশি বাজার/সুপারমল, বহুতল ভবন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ডিজাইন করার সময় (সেটা আর্কিটেক্ট করুক কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে নিজেরা) সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জন্য নামাজের স্থান/কমিউনিটি স্পেস রেখে ডিজাইন করা হয়। রাস্তা ডিজাইনের সময় মসজিদ/উপাসনালয় অধিগ্রহণ করলে আরো বড় মসজিদ/উপাসনালয় তৈরি করে দিতে হয় সরকারকে। অমুসলিম যেকারো বাড়িতে টয়লেটের ডিজাইনের সময় সেটাকে পূর্ব-পশ্চিমমূখী করা যায়না তার বড় কারণ এ দেশের ৯০% মুসলমান এবং তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে। ধর্মীয় রীতিনীতির প্রভাব একটি দেশের সামাজিক রীতিনিতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করে এটা সর্বজন স্বীকৃত। তাই মোটাদাগে "শুধু নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ইসলামিক কর্মকাণ্ডের জন্য তৈরি ‘বিল্ডিং” হিসেবে চিহ্নিত করাটাই ভুল হবে।

অন্যদিকে পুরোনো ঢাকায় এখোনো চোখে পড়ে নান্দনিক মন্দির কিন্তু নতুন ঢাকাতে মন্দির পাওয়া ভার। প্রতিবছর দূর্গাপুজার (১ সপ্তাহ) সময়ে তাই উত্তরা কিংবা গুলশান/বসুন্ধরায় পার্ক অথবা খেলার মাঠ কিংবা কমিউনিটি স্পেসের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে আমরা দেখতে পাই অস্থায়ী মন্দির। হিন্দু অধ্যুষিত ভারতের কোন শহরে নিশ্চয়ই এমনটা দেখা যায়না। নতুন ঢাকার এই যে অস্থায়ী মন্দির এর সুবিধা এবং অসুবিধা দুইই রয়েছে। সুবিধা হচ্ছে এর জন্য আলাদা করে কোন স্থান নির্ধারণ করতে হচ্ছেনা ফলে আমাদের যে স্থান/জমির সংকট সেটার একটা সমাধান হয়েছে বরং একটি প্লেস (পার্ক/মাঠ/কমিউনিটি প্লেস) বিভিন্নরকম কাজে একইসাথে ব্যবহার (multipurpose use) করা যাচ্ছে। আবার ঐ একই জমি বিভিন্ন ধর্মের জনগণ ব্যবহার করতে পারছে যেটা হয়তো স্থায়ী অবকাঠামো থাকলে সম্ভব হতনা। একই কথা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠের বেলায়ও (যা বছরের ৪ টা নির্দিষ্ট দিনের জন্য ব্যবহার হয়) প্রযোজ্য। তাই “ধর্ম তাই আটকে গেছে মসজিদ বা মন্দিরের স্থানাঙ্কে। এর বাইরের যে শহর, রাস্তাঘাট, বাজার, পরিবহন আর বিনোদনকেন্দ্র, সেখানে ধর্মের উপস্থিতি সীমিত এবং প্রায়শই নিগৃহীত। তারা তখন তাদের মতো করে, নগর-পরিকল্পনার ফাঁকফোকর গলে নগরীতে তাদের ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-ব্যবস্থা পালনের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করে। ” এটা অনেকাংশে সঠিক হলেও এর সুবিধাগুলোও খেয়াল করতে হবে এবং আমাদের সীমিত জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

নিউইয়র্ক শহরে ‘কালচারাল সেন্টার’ নামক ভৌতিক অবকাঠামো রয়েছে যেখানে ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ব্যবহার করতে পারে নির্দ্বিধায়। একই ভবনের ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোর ভিন্ন ধর্মের মানুষের ব্যবহারে রেষারেষি বা যুদ্ধ বাঁধেনা কারণ সেখানের সামাজিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সুশাসনের কারণে। এখোনো এদেশে দেহপসারীনির কবর হয়না, মসজিদে নারীদের প্রবেশ্যতা নেই। অথচ এ শহর একজন পুরুষের যেমন তেমনি একজন নারীর, একটি শিশুর, একজন আদিবাসীর, একজন দেহপসারীনির কিংবা শ্রমিকের। মূলত যিনিই এ শহরে বসবাস করবেন সে শহর তার। তবুও পাশাপাশি মসজিদ এবং মন্দির থাকা বা ধর্মভিত্তিক সুষম পরিকল্পনা করা আমাদের শহরে অচিন্তিনীয় কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের শ্রেণি বিদ্বেষ, বৈষম্য, বঞ্চনার ইতিহাস। এ সবই আমাদের সামাজিক অবকাঠামোর প্রতিফলন।

“যেখানে ‘আধুনিক’ নগরের মডেল নগর এবং ধর্মের সংযোগকে গুরুত্ব দেয় না। এর ফলে ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিশাল জনগোষ্ঠী নিজেদের নগরীর অংশ হিসেবে ভাবতে পারে না, বরং ধরেই নেয়, নগরীতে তারা উপেক্ষিত। “ এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলতে চাই একটি দেশ বা শহরে ধর্মের প্রয়োজন রয়েছে আর সেটা যেকোন বা অনেকগুলো ধর্ম হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে একইসাথে ধর্ম অনেক স্পর্শকাতর বিষয়। সামাজিক অবকাঠামোর ভিন্নতার জন্য একই ধর্ম বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহরে ভিন্ন সাংস্কৃতিক রীতিনীতির জন্ম দেয়। তাই শুধু ধর্মকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা করা হলে সেটা সবসময় সঠিক নাও হতে পারে বরং তৈরি করে দিতে পারে ধর্মবিদ্বেষ। যেখানে বৌদ্ধ মতালম্বীদের শহর লামাতেও আমরা দেখতে পাই মৌলবাদীদের তান্ডব। পাশের দেশ ভারতে মসজিদ বা উপাসনালয়ে হামলা হলে আমাদের দেশেও অমুসলিমদের উপাসনালয় বা মন্দিরে হামলা চলে। পরিপূর্ণ শিক্ষার অভাব থাকলে বা অন্য ধর্মকে সম্মান দিতে না জানলে ধর্মভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করে দিতে পারে নাগরিক বিভাজন বা বৈষম্যের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি। বরং একটি শহরে বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা বেশি প্রয়োজন যেন যে কোন ধর্মীয় মতবাদ অনুসারীরাই সেই নগরকে তার নিজের নগর এবং সেও সেই নগরীর অংশ ভাবতে পারে। যেন ধর্ম, শ্রেণি, বর্ণের উর্দ্ধে একটা নগরী যেন সাম্যতার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা হয়।