Blog

25 Jul 2013

Author: Md. Salauddin

ঢাকা শহরের যোগাযোগ ভাবনাঃ মেট্রোরেল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

ঢাকা শহরের যানজট হ্রাস ও গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়তনকে  সামনে রেখে গত ১৯ শে ডিসেম্বর প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। টাকার অংকে পদ্মা ব্রীজের প্রাক্কলিত বাজেটের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প হতে যাচ্ছে এটি। আমরা আশা করছি এই প্রকল্প ঢাকার দুঃসহ যানজট কমাতে সাহায্য করবে। তিনটি পর্যায়ে ২০২২ সালে শেষ হলে এটি প্রতি ঘন্টায় ৬০,০০০ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে যা রাস্তায় অন্যান্য যানবাহনের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। সংখ্যাটি তাত্ত্বিকভাবে সত্য কিন্তু ঢাকা শহর এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে শুধুমাত্র একটি বা দুটি রুটে যানজট কমিয়ে পুরো শহর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। ঢাকায় এখন বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিজনেস হাব (Central Business District) রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়, এর আগে ও পরে আশেপাশের ভূমির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে তা অনুমান করা যায়। অপরদিকে শুধু পরিকল্পনা কমিশনের হিসেব মতেই প্রতিবছর ঢাকার জনসংখ্যা ৫ লাখ এর বেশী করে বৃদ্ধি পাবে, সাথে সাথে বাড়বে বিভিন্ন কাজে প্রতিদিন ঢাকায় যাওয়া-আসা লোকের সংখ্যা। যদি ধরেও নিই মেট্রোরেল প্রকল্প শেষ হলে ঢাকার যানজট আর থাকবে না, বর্তমান বা ২০২২ সাল পর্যন্ত যানজট মোকাবিলা ও সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিকট ও দূর ভবিষ্যত বিবেচনায় একান্তভাবে জরুরী।

শহরের যোগাযোগব্যবস্থা পরিচালনায় দুটি উপায় সবখানে ব্যবহৃত হয়- ভৌত অবকাঠামো যেমন রাস্তা, ফুটপাত, যোগাযোগ মাধ্যম, ট্রাফিক ব্যবস্থার নকশা ও নির্মাণ (Design Measures) এবং অন্যটি হলো নিয়ম-কানুনের (Regulatory Measures) প্রয়োগ যা আমাদের শহর পরিকল্পনায় সবসময় উপেক্ষিত হয়ে আসছে। এদুটির সমন্নয় না হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা তার কাঙ্খিত সাফল্য লাভ করতে পারে না। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি বাস্তবায়নে আর্থিক প্রয়োজন খুবই সামান্য এবং সরকার ও জনসাধারণের মিলিত ইচ্ছাই এখানে প্রধান। ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় উপরোক্ত দুই পদ্ধতির সমন্বয়ে কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা উত্থাপন  যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছি।

ভৌত পরিকল্পনাঃ

ঢাকা শহরের আয়তন অনুসারে যে পরিমাণ রাস্তা থাকার কথা আছে তার ৫০ শতাংশেরও কম। নতুন রাস্তা তৈরীর সুযোগও কম। তাছাড়া নতুন রাস্তা  নতুন চাহিদাও তৈরী করে। আর টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হল নূন্যতম সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে নেওয়া। সরকার নতুন রাস্তা না করে যা করতে পারেঃ

১। কৌশলগত যোগাযোগ পরিকল্পনা ২০০৫ (Strategic Transport Plan) অনুসারে প্রধান কয়েকটি রুটে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (Bus Rapid Transit) এবং এর সাথে সাথে মিনিবাস ও গণপরিবহনে ব্যবহৃত অন্যান্য ছোটযানের পরিবর্তে শহরে চলাচল উপযোগী বড় ও দোতলা বাস চালু করা। এখানে ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর কিউরিতিবা’র বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের উদাহরণ দেওয়া খুবই যুক্তিসংগত। ১৯৭১ সালে,  নতুন নির্বাচিত মেয়র Jaime Lerner যিনি নিজে একজন নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি- অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের পরিবর্তে গণপরিবহনের মাধ্যমে শহরকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেন। আজ ৩০ লক্ষ লোকের শহরে প্রতিদিন ৭০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করছে। এই শহরে আছে ১৫০ কিমি সাইকেল লেন। কিউরিতিবা’র বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রতিদিন ২৫ লক্ষ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। পুরো প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে হয়েছে এবং এখনও কোন ভর্তুকি দিতে হয় না। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৯৯ ভাগ নগরবাসী তাদের শহর নিয়ে গর্বিত। দীর্ঘ ২২ বছর এক টানা মেয়রের দ্বায়ীত্ব পালনের পর Lerner রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং এখন বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।  

২। বিদ্যমান সড়ক গুলোতেই বাসের জন্য  একটি আলাদা লেন এবং ট্রাফিক সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন করে গণপরিবহন মাধ্যমকে আরও দ্রুতগামী করানো যায়। যেখানে সংযোগ সড়ক দুয়ের অধিক নয় সেখানে প্রাইভেট কার ও অন্যান্য গাড়ী সিগন্যাল এ দাঁড়াবে আর পাশের বাস লেন দিয়ে বাস চলে যাবে। এতে করে একদিকে বাস চলাচল দ্রুততর হবে অন্যদিকে বেশী সময় লাগার ফলে প্রাইভেট কার চলাচল নিরুৎসাহিত হবে।

৩। বাসের দরজা একটি হুইল চেয়ার ঢোকার মত প্রশস্ত হবে এবং দরজা ও বাস স্টপেজ এর উচ্চতা একই হবে যাতে শিশু-বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী সহজে উঠতে পারে। বাসে ড্রাইভারের পিছনে কিছু অংশ ফাঁকা রাখার ব্যবস্থা থাকবে।

৪। ফুটপাতগুলো দখল মুক্ত করে পথচারী চলাচলের উপযোগী করতে হবে। এর উপকারীতা বহমুখী।  যেমন দিনের ব্যস্ত  সময়ে ফার্মগেট থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত বাসে যেতে ১০-১৫ মিনিট লাগে। অথচ হেঁটে গেলে এর চেয়ে কম সময়ই লাগবে। ফুটপাতগুলো সংস্কারের ফলে স্বল্প দূরত্বে বাস রা রিকশার ব্যবহার কমবে। ফুটপাত ব্যবসায়ীদের সপ্তাহের দিন অনুসারে রেশনিং অথবা সুবিধাজনক স্থানে স্থানান্তরিত করা যেতে পারে।

৫। বিশ্বের বড় বড় শহর গুলোতে হাজারো যানবাহনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে যা চোখে পড়ে তাহল সাইকেলের ব্যবহার। বেশীরভাগ জনসমাগমের জায়গায় সাইকেল রাখার আলাদা জায়গা রয়েছে এবং ভাড়ায় সাইকেল পাওয়া যায়। ঢাকা শহরে যদি আলাদা সাইকেল লেন করা যায় তাহলে লক্ষ লক্ষ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও নবীন চাকুরীজীবীদের সহজেই আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।

৬। সাভার, আমিনবাজার হয়ে প্রচুর পণ্যবাহী ট্রাক পুরো শহরের ভিতর দিয়ে যাত্রাবাড়ি বা পুরান ঢাকার আড়তগুলোতে যায়। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে আমিনবাজার হতে নৌপ থে পণ্য আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে যাত্রী পরিবহনের জন্য মহা ধুমধামে শুরু হওয়া সি-ট্রাক প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, লোকবল ও তদারকির অভাবে এখন বন্ধপ্রায়। এদিকেও প্রয়োজনীয় দৃষ্টিপাত আশু কাম্য।  

৭। শহরের বিভিন্ন প্রবেশ মুখে বিনামূল্যে গাড়ী পার্কিং এর ব্যবস্থা রাখা যাতে করে মানুষ সেখান থেকে গণপরিবহন ব্যবহার করে কর্মস্থলে আসতে পারে। কল্যাণপুর, বনানী, সায়েদাবাদ এরকম কয়েকটি জায়গা হতে পারে।  

ভৌত অবকাঠামো ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশে কোন সরকারকেই এ বিষয়ে খুব বেশী আন্তরিকভাবে কাজ করতে দেখা যায় নি। আবার এখানে সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণেরওএকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনস্বার্থে প্রণীত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সরকারের কাজে সাহায্য করা প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এক্ষেত্রে যা করা যেতে পারেঃ

১। মেট্রোপলিটান এলাকার ভিতর চলাচলকৃত ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ীর জন্য মাসিক বা বাৎসরিক টোল এবং নির্দিষ্ট সময়ের বেশী অবস্থানকারী গাড়ীর বিপরীতে পার্কিং মাশুল  আদায় করা যেতে পারে যা পরবর্তীতে রাস্তার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ হবে। ছোট গাড়ী আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে।

২। ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ীর নম্বর প্লেট অনুসারে সপ্তাহের একটি দিন ব্যবহার থেকে বিরত রাখা যেতে পারে।

৩। ট্রাফিক পুলিশের আধুনিকিকরণ ও যথাযথ ক্ষমতায়ন এবং ট্রাফিক আইন অমান্যকারীকে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধনে যথাশীঘ্র সম্ভব কাজ শুরু করা দরকার।

৪। সর্বশেষ, কিন্তু আমার মতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো চালকদের ট্রাফিক আইন ও গাড়ী চালনা বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে অবহেলার কোন সুযোগ নেই। লক্ষ মানুষের জীবন যার হাতে তাকে আমাদের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেই হবে।

শহর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সঠিক ভূমি ব্যবস্থাপনার দ্বারা মানুষের যাতায়াতের ধরণ ও পরিমাণ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোন স্থাপনা অনুমোদনের আগে আশেপাশের এলাকায় এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে ধারণা ও তদানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ণ ও প্রয়োগের দ্বায়ীত্ব  নগর পরিকল্পনাবিদের তত্বাবধানে থাকা বাঞ্চনীয়। প্রয়োজনে কিছু শর্ত যেমনঃ ডেভেলপার কর্তৃক বেজমেন্ট পার্কিং, ফুটপাথ সংস্কার, ফুটওভারব্রীজ নির্মাণ বা নির্মাণ পরবর্তী শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়ার প্রয়োজনীয় বিধিমালা অন্তর্ভুক্ত করা।

উন্নত বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ নগরে বসবাস করলেও বর্তমান সময়ে উন্নয়নশীল দেশে নগরায়নের হার খুব দ্রুত এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা ঘটছে। সেই তুলনায় নগর সুবিধা অপ্রতুল। আমাদের সচেতনতাই পারে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সুন্দর দেশ রেখে যেতে। আমাদের মনে রাখতে হবে শহর হলো মানুষের জন্য, মানুষের তৈরী কৃত্রিম একটি পরিক্ষণক্ষেত্র যেখানে পরিস্থিতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলব্ধ অনুমানের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত কাজের দ্বারা তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।