19 Oct 2013
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর মাস্টার্স, পিএইচডি, পোস্ট-পিএইচডি এবং সাময়িক (split site basis)- এই চারটি বিভাগে প্রায় ৩৫-৪০ জনকে বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাজ্যে ‘Commonwealth Scholarship' প্রদান করা হয়। প্রথমেই বলে রাখি, আমি ২০১৩ সালে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা (Urban and Regional Planning) বিভাগে ‘পিএইচডি’ করার জন্য ‘Commonwealth’ বৃত্তি পেয়েছি। তাই নিম্নে সাম্প্রতিক সময়ের (২০১২-১৩) বাস্তব-অভিজ্ঞতা থেকে এই বৃত্তি অর্জন করার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করলামঃ
[১] সর্বপ্রথমে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (UGC) ও বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়- এর ওয়েবসাইট এবং জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কমনওয়েলথ বৃত্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০১২ সালের ৩০ শে আগস্ট এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখ ২-৩ সপ্তাহ আগে/পরে হতে পারে। তাই আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর- এই দুই মাস, বিজ্ঞাপনের আশায় একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
[২] বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণত ২-৩ সপ্তাহ) আপনাকে নির্ধারিত ছকে আবেদনপত্র, শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় সনদ (SSC+HSC+Bachelor/MSc), IELTS, পাসপোর্ট সাইজের ছবি ইত্যাদির সত্যায়িত কপি ‘UGC’ ভবনের নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে জমা দিয়ে আসতে হবে। ২০১২ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর ছিল আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। এছাড়া আবেদনপত্রের সাথে ৫ টাকার ডাকটিকেটযুক্ত একটি ৯.৫ʹʹ × ৪.৫ʹʹ আকারের খামে নিজের নাম ও ঠিকানা লিখে জমা দিতে হবে। আপনি মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হলে, এই খামে করে ‘UGC’ আপনাকে নিশ্চিতকরণ চিঠিটি প্রেরণ করবে।
[৩] ‘UGC’ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিটি বিষয়ে শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ততালিকাভুক্তপ্রার্থীদেরকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এই সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করা হয় ‘SSC+HSC+Bachelor/MSc/PhD’-এ প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে। ‘UGC’-এর প্রার্থী বাছাই অনেকটা এভাবে হয়ে থাকে (পিএইচডি):-
এসএসসি = ৭%
এইচএসসি = ১৩%
স্নাতক = ৫০%
স্নাতকোত্তর = ১০%
মোট = ৮০%।
এভাবে ৮০% নম্বরের ভিত্তিতে, আপনাকে প্রাথমিকভাবে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়।
** বাকি ২০% = মৌখিক পরীক্ষা; সর্বমোট = ১০০%।
মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত সকল প্রার্থীর নাম, পরীক্ষার স্থান, সময় এবং তারিখ ‘UGC’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত প্রার্থীদেরকে, খামে করে নির্ধারিত ঠিকানায় ডাকযোগে চিঠি পাঠানো হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আপনার দেয়া ঠিকানায় চিঠি না পৌঁছালেও, ওয়েবসাইট দেখে আপনি নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
মাস্টার্স’ এবং ‘পিএইচডি’ পর্যায়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত সংক্ষিপ্ততালিকাভুক্তপ্রার্থীদের তালিকার নমুনা লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন। আমার মৌখিক পরীক্ষা হয়েছিল ৫ ই নভেম্বর ২০১২, দুপুর ২ ঘটিকায় ‘UGC’ ঢাকা অফিসে।
[৪] মৌখিক পরীক্ষার দিন আনুষ্ঠানিক/ ফরমাল পোশাক পরিধান করে যেতে হবে। সাধারণত কয়েকটি বিষয়ের মৌখিক পরীক্ষার জন্য একটি বোর্ড থাকে। ঐ বোর্ডের প্রধান থাকেন ইউজিসি-এর একজন মেম্বার। আরও প্রায় ৫-৮ জন প্রবীণ শিক্ষক থাকবেন।
[৫] যারা আবেদন করতে আগ্রহী তাঁরা অবশ্যই ২ টি জিনিস এখন থেকেই সংগ্রহ করে রাখেন, পরে সময় পাবেন নাঃ-
** এই Documents-গুলি থাকলে, 'Viva' পরীক্ষাতে আপনার 'Chance' পাবার সম্ভাবনা অনেক গুণে বেড়ে যায়। আর IELTS পরীক্ষার ফলাফল থাকলেও ভাল।
[৬] মৌখিক পরীক্ষার সময় অবশ্যই সাথে নিয়ে যাবেন- সকল পরীক্ষার Marks Sheets, Transcripts, Certificates, CV, Bachelor/MSc thesis, Publications, Job Experience Certificates, প্রবেশ পত্র, কলম ইত্যাদি।
এছাড়াও বোনাস হিসাবে নিতে পারেন- Unconditional Offer Letters, Research Proposal, IELTS score ইত্যাদি।
[৭] মৌখিক পরীক্ষার পরের দিনই ফলাফল প্রকাশিত হয়ে যায়। এইসব নির্বাচিত প্রার্থীদেরকে বলা হয়ে থাকে- ‘UGC Nominated Candidates’। এই মুহূর্তে আপনি ৬০% নিশ্চিত হয়ে পারেন যে আপনি ‘Commonwealth Scholarship’ পেতে যাচ্ছেন। তবে ইহাই কিন্তু চূড়ান্ত বাছাই পর্ব নয়।
[৮] এরপর আপনাকে UGC-তে গিয়ে একটি কাগজ নিয়ে আসতে হবে। ওইখানে বিস্তারিত লেখা থাকবে, আপনি কিভাবে EAS (Electronic Application Systems)- এর মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশান করে আবেদন করবেন।
[৯] এই পর্যায়ে, আপনাকে অতি-দ্রুত (আনুমানিক ২ সপ্তাহ) EAS- এর অনলাইন ফর্ম পূর্ণ করে এবং প্রিন্ট নিয়ে UGC-তে গিয়ে ৫ সেট জমা দিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও পিএইচডি-এর ক্ষেত্রে আপনাকে মাত্র এক মাসের মধ্যে অনলাইলে নিম্নলিখিত Scanned copy upload/manage করতে হবেঃ
আমার ক্ষেত্রে, UGC-তে Hard Copy জমা দেয়ার সর্বশেষ সময়সীমা ছিল নভেম্বর ২০, ২০১২ এবং অনলাইনে EAS জমার দেয়ার ডিসেম্বর ৭, ২০১২।
[১০] নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে গবেষণা করার জন্য প্রধানত বৃত্তি দেয়া হয়ে থাকেঃ
তাই, এই সকল বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে Research Proposal Develop করা উচিত।
[১১] এছাড়াও EAS-এর নিম্নের চারটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত মনোনয়ন করে থাকে ‘Commonwealth Scholarship Commission’। আমার কিছুটা দুর্বল ইংলিশ লেখাগুলো নমুনা হিসাবে তুলে ধরলাম। আশা করি আরও ভালভাবে লেখার জন্য ভবিষ্যতে এই নমুনাগুলো আপনাদের উপকারে আসবে।
[১২] এইভাবে UGC-তে Hard Copy এবং অনলাইনে আবেদন পত্র জমা দেয়ার প্রায় ২-৩ সপ্তাহ পর British Council থেকে আপনার বাসার ঠিকানায় IELTS পরীক্ষা দেয়ার জন্য চিঠি আসবে। এরপর British Council-এ গিয়ে, আপনাকে তাদের নির্ধারিত সময় ও তারিখে Academic IELTS-এর জন্য রেজিস্ট্রেশান করতে হবে। এক্ষেত্রে UGC Nominated Candidate হওয়ায়, আপনাকে কোন রেজিস্ট্রেশান ফি দিতে হবে না। আমার IELTS পরীক্ষা হয়েছিল জানুয়ারি ১২, ২০১২ তারিখে।
মনে রাখতে হবে, আপনাকে এই IELTS পরীক্ষায় কমপক্ষে Overall 6.5 (কোন Band-এ কমপক্ষে ৫.৫) পাইতে হবে। নাহলে আপনার বৃত্তি বাতিল হয়ে যাবে। আমি এই IELTS পরীক্ষায় Overall 6.5 পেয়েও, কমনওয়েলথ পিএইচডি বৃত্তি পেতে দেখেছি। তাই এই পরীক্ষায় যে ৮/৯ পেতে হবে, এমন কোন ধারণা সঠিক নয়।
[১৩] এই IELTS পরীক্ষা হয়ে যাবার পর, আপনার আর কিছু করণীয় নাই। শুধু চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা। এখন ‘Commonwealth Scholarship Commission (CSC)’ আপনার সকল কাজগপত্র যাচাই-বাছাই করবে। জেনে রাখা ভাল, বাংলাদেশ থেকে ২ ভাবে এই কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য আবেদন করা সম্ভব।
২০১৩ সালের জন্য বাংলাদেশ থেকে UGC, এই দুই ক্যাটাগরি মিলিয়ে প্রায় ৭৮ জনকে Nominate করেছিল। কিন্তু চূড়ান্তভাবে ‘CSC’ সর্বমোট ৩৪ জনকে (এর মধ্যে ১২ জন মাস্টার্স, বাকিরা পিএইচডি এবং স্প্লিট টাইপ) সিলেক্ট করে। অর্থাৎ সর্বশেষে আপনার চান্স পাবার সম্ভাবনা মাত্র প্রায় ৪৪%। আমার ধারণা মতে, এই ৩৪ জনের মধ্যে প্রায় ৯০% হলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! যদিও আমি তখন একটি বেসরকারি ফার্মে কর্মরত ছিলাম!!
[১৪] যাইহোক, এখনও বেশি হতাশ হওয়ার কিছু নাই। দীর্ঘ অপেক্ষার পর, এপ্রিলের শেষ বা মে মাসের শুরুতে CSC থেকে ডাকযোগে সকল Candidate-দেরকে একটি খাম পাঠানো হবে (আমি পেয়েছিলাম ১৬ই মে, ২০১৩)। যদি ঐ চিঠিতে বলা থাকে, ‘The Commission has provisionally selected you for a Commonwealth Scholarship........’; এর মানেই, আপনি ৯০% কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে গেছেন। এখানে উল্লেখ করা থাকবে, আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেন। এছাড়াও আপনাকে একজন ‘Programme Officer’-এর email ID দেয়া হবে। এই ‘Programme Officer’-এর সাথেই, এখন থেকে শুরু করে আপনার বৃত্তির শেষ দিন পর্যন্ত যাবতীয় যোগাযোগ রাখতে হবে। উনি আপনাকে সর্বক্ষেত্রে ‘Guideline’ দিবেন। এছাড়াও এই খামে থাকবেঃ
[১৫] উপরের ফর্ম দুইটি সঠিকভাবে পূরণ করে পাঠিয়ে দেয়ার পর, আবার অপেক্ষার পালা। এবার প্রায় ৪-৬ সপ্তাহ পর আপনি email-এর মাধ্যমে পাবেন, ‘Notification of Award’ (আমি পেয়েছিলাম আগস্ট ০১, ২০১৩)। এই ‘Notification of Award’-এ নিম্নলিখিত তথ্য দেয়া থাকবেঃ
** এর শেষ পৃষ্ঠায় Award Acceptance Form’ থাকে। ইহা পূরণ করে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে হবে। এর সাথে দিতে হবে আপনার নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়েরUnconditional Offer Letter।
[১৬] এরপর বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিল একটি Pre-departure Workshop-এর আয়োজন করবে। এইখানে আপনি বাংলাদেশের এই বছরের সকল কমনওয়েলথ স্কলারের সাক্ষাৎ পাবেন! এছাড়াও ব্রিটিশ কাউন্সিলে যোগাযোগের একটি মাধ্যম পাবেন। এর মাঝে আপনি অবশ্যই, আপনার নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Confirmation of Acceptance for Studies (CAS)’ এবং TB (Tuberculosis testing) Test Certificate সংগ্রহ করে রাখবেন। এই TB testing-এর টাকা CSC আপনাকে UK আসার পর দিয়ে দিবে।
[১৭] অবশেষে, ২-৪ সপ্তাহ পর আপনি ই-মেইলের মাধ্যমে ‘Confirmation of Award’ পাবেন (আমি পেয়েছিলাম আগস্ট ২৯, ২০১৩)। এর মানে আপনি এখন ১০০% বৃত্তি পেয়েছেন। এই ‘Confirmation of Award’ আবার ‘Express Courier’-এ করে আপনার নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। আপনি এই Courier/ ই-মেইল মিলিয়ে পাবেনঃ
[১৮] এরপর আপনাকে VFS Bangladesh -এর মাধ্যমে UK ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। একজন কমনওয়েলথ স্কলার হিসাবে আপনাকে ভিসা আবেদনের ফি দিতে হবে না!
[১৯] ভিসা পাইতে আপনাকে ১-৩ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। ভিসা পেয়ে যাবার পর, বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিলে যোগাযোগ করবেন। উনারা আপনার সুবিধামত সময় এবং তারিখের প্লেনের ই-টিকেট পাঠিয়ে দিবে। আবারও একজন কমনওয়েলথ স্কলার হিসাবে আপনাকে বিনামূল্যে এই টিকেট দেয়া হবে!
[২০] সবশেষে আমি আরও কিছু দরকারি ওয়েব-লিংক আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। আশা করি, এই লেখা আপনাদের একটু হলেও উপকারে আসবে। আরও প্রশ্ন থাকলে, দয়া করে কমেন্ট করুন। আমি যথাসম্ভব আপনাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করবো। সকলের জন্য শুভ কামনা রইল! সবাই ভাল থাকবেন, ধন্যবাদ!!
____________________________________________________________
*** কৃতজ্ঞতাঃ বাবা-মা, গোলাম রহমান স্যার, কালাম স্যার, আজাদ স্যার, মুহিবুর স্যার, আশরাফ ভাই, রাকিব স্যার, ইশতিয়াক ভাই, লিটন ভাই, মঞ্জুর প্রামানিক ভাই, সালাউদ্দিন সজল, রিমি ম্যাডাম, রিমন ভাই, আবদুল্লাহ ভাই, ডেভিড অ্যালেক্সান্ডার, শাহিন ভাই, তোফা ভাই এবং বুশরা ইসলাম।